নারীর উপর ক্রমাগত দৃশ্যমান পুলিশী হয়রানী: জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের করণীয় কি?

লেখক: মোঃ আব্দুল হালিম, বার-এট-ল

সাম্প্রতিককালে পুলিশ কর্তৃক সাধারণ মানুয়ের উপর অমানবিক নির্যাতন এবং হয়রানীর ঘটনা অহরহ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। গত এক বছরে পুলিশের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছে কমপড়্গে ৪০ নারী। নববর্ষে নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদে ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচীতে পুলিশ অমানবিকভাবে পিটিয়েছে ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী ইসরাত জাহানসহ আরও কয়েকজনকে। পুলিশের নির্যাতনে ইসরাত আজ প্রায় পঙ্গু। বার বার ঘটে যাওয়া এরূপ প্রকাশ্য মানবাধিকার লংঘনেও আমাদের মানবাধিকার কমিশন নিশ্চুপ কেন? আইনে তার কি কিছুই করণীয় নেই? এটা সত্য যে, মানবাধিকার কমিশন কোন আদালত নয়। তবে কমিশন মানবাধিকার লংঘনের জন্য সরাসরি কাউকে শাসিত্ম দিতে না পারলেও ইহা যথাযথ কার্যক্রমের মাধ্যমে শাসিত্ম এবং ড়্গতিপূরণ এনে দিতে পারে। উলেস্নখ্য, ভারতীয় মানবাধিকার কমিশন গত বিশ বছরে ৩,২১৪টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় ভুক্তভোগীদেরকে ৭০,৪১,৫৩,৫০০ ভারতীয় রম্নপি ড়্গতিপূরণ সুপারিশ করেছে সরকারী সংস্থাসমূহের বিরম্নদ্ধে এবং উক্ত ড়্গতিপূরণ আদায় নিশ্চিত করেছে। ২০১৪ সালের জুন মাসে ভারতীয় কমিশন ড়্গতিপূরণের সুপারিশ করেছে ২৬,৫০,০০০ রম্নপি; জুলাই মাসে ৬১ লড়্গ রম্নপি; †m‡Þ¤^‡i ৩১,৫৫,০০০ রম্নপি; অক্টোবরে ৪৮ লড়্গ রম্নপি। আইনে বাংলাদেশের কমিশনের সমান এবং কিছু ড়্গেত্রে বেশী ড়্গমতা থাকা সত্ত্বেও এবং মানবাধিকারের লংঘন প্রকাশ পাওয়ার পরও একটি ড়্গেত্রেও কমিশন এখন পর্যনত্ম ড়্গতিপূরণের সুপারিশ করেনি। অথচ এই ড়্গতিপূরণের সুপারিশই হওয়া উচিৎ কমিশনের মূল লড়্গ্য। দ্বিতীয়ত, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী কর্তৃপড়্গের বিরম্নদ্ধে কমিশন যথাযথ শাসিত্মমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য ১৯(১)(ক) এবং ১৮(৩)(খ) উপ-ধারায় সরকারকে সুপারিশ করতে পারে। কর্তৃপড়্গ ব্যবস্থা না নিলে কমিশন হাইকোর্টের দারস্থ হতে পারে অথবা জনসমড়্গে তার কার্যক্রম তুলে ধরতে পারে। ড়্গতিপূরণ এবং শাসিত্মমূলক ব্যবস্থার সুপারিশের মাধ্যমেই কমিশন সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানবাধিকার লংঘনের দায়ে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনটির ১৮ ধারা পড়লে আপাতত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, আইন-শৃঙ্খলা রড়্গাকারী বাহিনীর সদস্য কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে কমিশনের প্রতিবেদন চাওয়া ছাড়া অন্য কোন ড়্গমতা নেই। কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর এরূপ বক্তব্যই দিয়ে আসছেন; এ কারণেই কমিশনের চেয়ারম্যান জাতিকে শুনিয়ে দিলেন, “কমিশনের দাঁত নেই, জিহ্বা আছে।” কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় যে, কমিশনের চেয়ারম্যানের এই বক্তব্য আইনগত দৃষ্টিকোন্ থেকে কতখানী গ্রহণযোগ্য।

প্রথমত, আইনের ১৮ ধারার সাথে ভারতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনের ১৯ ধারার সাথে হুবহু মিল রয়েছে। কিন্তু ভারতীয় কমিশন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরম্নদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের তা গ্রহণ করা উচিত। লড়্গ্যণীয়, ভারতীয় আইনের ১৯ ধারায় “কমিশন সন্তুষ্ট হইলে” কথাগুলো নেই; কিন্তু বাংলাদেশের আইনে শর্ত দেয়া হয়েছে “কমিশন সন্তুষ্ট হইলে,”। সুতরাং শৃংখলা বাহিনীর সদস্য কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ড়্গেত্রে ভারতীয় কমিশনের চেয়েও বেশী ড়্গমতা বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কমিশন আইন প্রয়োগের চেষ্টা করছে না।

দ্বিতীয়ত, আইনটির ১৮(১), ১৮(২), ১৮(৩), ১৮(৪) এবং ১৮(৫) উপ-ধারার বিধানসমূহ অন্যান্য বিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করলে বোঝা যায় যে, কমিশনের হাত পা বাধা নয়: (i) ১৮(২) উপ-ধারা অনুযায়ী সরকার কমিশনকে প্রতিবেদন সরবরাহ করবে (shall); কিন্তু কতদিনের মধ্যে সরবরাহ করবে তা বলা হয়নি। সুতরাং কমিশন সরকারকে সময় বেঁধে দিতে পারে; (ii) কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন না পেলে কমিশন ১৮(৩)(খ) উপ-ধারা অনুযায়ী ভুক্তভোগীকে সাময়িক সাহায্যের সুপারিশ কেন করা হবে না তার কারণ দর্শাও নোটিশ জারী করতে পারবে যে কাজটি ভারতীয় কমিশন অহরহ করছে; (iii) ১৮(৩)(ক) উপ-ধারায় বলা হয়েছে যে, সরকারের নিকট থেকে প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর কমিশন সন্তুষ্ট হলে আর কোন উদ্যোগ গ্রহণ করবে না। কিন্তু কমিশন সন্তুষ্ট না হলে কি করবে তা বলা নেই। এখানেই কমিশনের ড়্গমতা প্রয়োগের একটি বড় ড়্গেত্র রয়েছে (v) “কমিশন সন্তুষ্ট হলে”- কথাটির আইনগত ব্যাখ্যা আছে। তথ্য-উপাত্ত/তদনেত্মর কাগজপত্রসহ প্রতিবেদন না পেলে কমিশন কি করে সন্তুষ্ট হবে যে, আইন-শৃংখলা বাহিনী তার প্রতিবেদনে প্রকৃত তথ্য লুকিয়েছে কি না? “প্রতিবেদন চাওয়ার” এবং “প্রতিবেদন পর্যালোচনা” করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানবাধিকার রড়্গার শক্তিশালী অস্ত্র। কিন্তু সেই প্রতিবেদন চাওয়ার প্রক্রিয়ায় কমিশন গত পাঁচ বছরে কোন দড়্গতা অর্জন করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। একটি রাষ্ট্রীয় ¯^vaxb কমিশন যদি ৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ে দরিদ্র জনগণের করের টাকা ব্যয় করে এতটুকু দায়িত্ব পালন না করতে পারে, তাহলে মানবাধিকার রড়্গা কি আদৌ হবে?

তৃতীয়ত, কমিশন কর্তৃক আইন-শৃংখলা রড়্গাকারী বাহিনীর বিরম্নদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিষ্পত্তির ধরন প্রশ্নবিদ্ধ। সরকারের থেকে প্রতিবেদন না পেয়ে কমিশন একের পর এক পত্র দেয়। কোন কোন ড়্গেত্রে তিন বছরেও সরকার প্রতিবেদন দেয়নি কিন্তু কমিশন নিশ্চুপ থেকেছে। কমিশনের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই ঢাকা মেট্রোপলিটন কমিশনার প্রকাশ্যে কমিশনের চেয়ারম্যানের বিরম্নদ্ধে বিরূপ মনত্মব্য করে, “আমরা কারোর সাথে বাহাসে জড়াতে চাই না।” ভারতীয় কমিশন ভারতীয় সরকার এবং বিএসএফকে কোনভাবেই ইহাকে ঠুঁটো জগন্নাথ ভাবার দুঃসাহস দেয়নি। ভারতীয় কমিশন প্রতিবেদন চায় নির্ধারিত দিনের মধ্যে এবং প্রতিবেদন পাওয়ার পর সন্তুষ্ট না হলেই সাময়িক সাহায্য ভিকটিমকে বা তার পরিবারকে কেন দেয়া হবে না তার কারণ দর্শানোর নোটিশ জারী করে। বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের এ ধরনের দু’একটা ঘটনায় প্রথমে সক্রিয়তা দেখাতে হবে। হয়তো সরকার সংড়্গুব্ধ হয়ে হাইকোর্টে যাবে? তাতে কমিশনের ভয় কিসের? কমিশন আইনী লড়াই করে মানবাধিকারের পড়্গে রায় ছিনিয়ে আনবে।

এখানে ভারতীয় কমিশনের দু’টি অভিযোগের উদাহরণ দেয়া বাঞ্ছনীয়:

প্রথমত, ২০০০ সালে কমিশন অভিযোগ পায় যে, বিএসএফ গুলি করে দু’জন নাগরিককে মেরে ফেলেছে। কমিশন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে প্রতিবেদন চায়। প্রতিবেদন পাওয়ার পর কমিশন সন্তুষ্ট না হতে পেরে ভিকটিমের পরিবারকে কেন ২ লড়্গ রম্নপি করে ড়্গতিপূরণ দেয়া হবে না তার কারণ দর্শাও নোটিশ জারী করে। ভারতীয় বিএসএফ এবং ¯^ivóª মন্ত্রণালয় কমিশনের এই ড়্গমতাকে চ্যালেঞ্জ করে। তখন ¯^ivóª সচিব ও বিএসএফ প্রধানকে কমিশন শুনানীতে তলব করে। বিএসএফ এবং ¯^ivóª মন্ত্রণালয় যুক্তি দেখায় যে, আইনের ১৯ ধারা কমিশনকে শৃংখলা বাহিনীর বিরম্নদ্ধে ড়্গতিপূরণের আদেশ দিতে কোন ড়্গমতা প্রদান করে না। কিন্তু মানবাধিকার কমিশন যুক্তি দেখায় যে, সরকার প্রতিবেদন দেয়ার পর এবং প্রতিবেদনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইঙ্গিত থাকলে কমিশন তার ড়্গমতা প্রয়োগে ১৯ ধারার সীমাবদ্ধতার মাঝে চুপ থাকবে না। ১৯(১)(খ) উপ-ধারায় [বাংলাদেশের ১৮(৩)(খ)] প্রদত্ত ড়্গমতা ব্যাপক এবং এই ড়্গমতা ভুক্তভোগী বা তার পরিবারকে সাময়িক সাহায্য প্রদানের ড়্গমতাকে অনত্মর্ভুক্ত করে। অবশেষে কমিশনের ব্যাখ্যা মেনে নিয়ে বিএসএফ ভিকটিমের পরিবারকে ২ লড়্গ রম্নপি ড়্গতিপূরণ প্রদান করে।

দ্বিতীয়ত, Res ipsa loquitur (ঘটনা যেখানে নিজেই নিজের বর্ণনা দেয়) নীতিটি টর্ট তথা ড়্গতিপূরণের আইনে বহুল প্রচলিত। অর্থাৎ কোন ঘটনা বা অপরাধ যদি এমনভাবে প্রকাশ্যে ঘটে তাহলে উক্ত ঘটনার অনুসন্ধান বা তদনেত্মর প্রয়োজন পড়ে না। এরূপ ড়্গেত্রে ভারতীয় মানবাধিকার কমিশন যুগানত্মকারী পদড়্গেপ নিয়েছে (বিশেষ করে গুজরাট দাঙ্গা বিষয়ে ২০০২ সালে কমিশন ¯^xq উদ্যোগে অভিযোগ গ্রহণ করে))।

নববর্ষে নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইসরাত জাহান যেভাবে পুলিশ কর্তৃক প্রকাশ্যে হয়রানী ও অমানবিক নির্যাতনের ¯^xKvi হয়েছে তাতে Res ipsa loquitur নীতিটি প্রয়োগ করে কমিশন অতি সহজে পুলিশের বিরম্নদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ এনে ড়্গতিপূরণের নির্দেশ দিতে পারত; কিন্তু দেয়নি। এমনকি হাইকোর্টে এ বিষয়ে মামলা দায়ের হলেও কমিশন পড়্গভুক্িতর আবেদনও দেয়নি। বিগত পাঁচ বছরে মানবাধিকার কমিশন যদি এ নীতিটি প্রয়োগ করে লিমন, কাদের, রানা পস্নাজা ধ্বস, শিশু জিহাদের অমানবিক অবহেলাজনিত মৃত্যুতে পদড়্গেপ নিত এবং সরকারকে ড়্গতিপূরণ প্রদানের সুপারিশ করত তাহলেও কমিশনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হতো। র‌্যাব বা সাংসদদের বিরম্নদ্ধে না হোক, অনত্মতঃ পুলিশের বিরম্নদ্ধে শিশু বা নারী নির্যাতনের অভিযোগগুলোতেও যদি একটু সক্রিয় হয়ে ড়্গতিপূরণের সুপারিশ করত, তাহলে সরকারের অন্যান্য বাহিনীগুলো সতর্ক হয়ে যেত; কমিশনকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভয় পেত এবং কমিশনের প্রতি সাধারণ নিপীড়িত মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পেত।

লেখক বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একজন আইনজীবী এবং সম্প্রতি প্রকাশিত “জাতীয় মানবাধিকার কমিশন: সমস্যা এবং প্রত্যাশা” নামক বইটির লেখক